পূর্বাহ্নে পদচিহ্ন
Posted on April 7, 2019 • 6 minutes • 1200 words
Table of contents
গল্পটা গত টার্ম ব্রেকের, ১-২ এর টার্ম ফাইনালের ল্যাঠা চুকিয়ে ভার্সিটি লাইফের প্রথম ট্যুর দিলাম। এর আগে কখনো বড় ট্যুর দেয়া হয় নাই লাইফে, এটাই প্রথম। আমাদের তেল খুউব বেশী হওয়ায় পিএলেই ট্যুর নিয়ে আয়োজন শুরু হল, বেশ বড়সড় করে। প্রথমে একটা পোল খুলে কে কোথায় যেতে চায়, কেমন বাজেট লাগবে ইত্যাদি নিয়ে সবশেষে ঠিক করা হলো যে আমরা সীতাকুন্ড ট্যুর দিব। একে একে করে মানুষ বাড়তে লাগলো, শেষে এসে সংখ্যা দাড়ালো ৪০ জন। পিএল এবং এক্সামের মাঝেই হোটেল ঠিকঠাক করে এবং ট্রেনের টিকেট করে ফেলা হল। আমরা ঠিক করলাম এতজন মানুষ নিয়ে থাকবো চিটাগং শহরে। তাই চিটাগং এ হোটেল আর ট্রেনের টিকিট কেটে ফেললাম পিএল আর এক্সামের মাঝে।
প্রথম দিন
প্ল্যানিং এ ছিলাম আমি, আফনান, স্বর্গ আর নাহিয়ান। পরবর্তীতে আরো অনেকে যুক্ত হয় পরোক্ষভাবে। যাই হোক, ১০ এপ্রিল শেষ এক্সাম দিয়ে সেদিন রাতেই রওনা দিলাম চিটাগং এর উদ্যেশ্যে। রাতে হই-হুল্লোড় করে, আড্ডা দিয়ে এক পর্যায়ে গিয়ে সবাই ঘুমায় গেলাম। আমার ঘুম ভাঙলো ভোরে, চোখ খুলে দেখি বামে পাহাড়, আর কী হিমেল বাতাস বইছিল !
ট্রেন থেকে নেমে আমরা অটো ভাড়া করে চললাম হোটেলে। সেখানে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে গেলাম জামান হোটেলে, নাস্তা করতে। নাস্তা শেষে সবাই আলাদা ভাবে রিকশা ভাড়া করে গেলাম বাস স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে বাসে করে চললাম কাপ্তাইয়ের পথে। কাপ্তাই নেমে সেখানকার বোট ক্লাবে কায়াকিং করলাম, একে একে। বেশ টাইম লাগতেসিলো সেখানে, তার উপরের রেস্টুরেন্টেই দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। কাপ্তাই আসার আগেই আমাদের ট্যুর ম্যানেজার সিহাত আফনান আগে থেকেই অর্ডার দিয়ে রাখসিলো। খাওয়া দাওয়া শেষে একটা রিসার্ভ বাসে করে গেলাম কাপ্তাই বাধ দেখতে। বাধ দেখা হল না নানাবিধ কারণে, কিন্তু ট্রলার ভাড়া করে গেলাম নৌবাহিনীর চেকপোস্ট দেখতে।
সেখানে দেখা করতে করতেই খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাতের আধারে নৌকায় যাওয়া সেফ হবে না বলে নৌকা চলে যেতে বললাম এবং বাস ডেকে আনালাম সেখানে। বাসের অপেক্ষায় না বসে আমি আর তাহমিদ হাটা দিলাম পাহাড়ি রাস্তায়। তাহমিদ ইস সাচ আ গুড ফ্রেন্ড, ইউ নো। গল্প করতে করতে আর হাটতে হাটতে দেখি বাস এসে আমাদের ক্রস করে বাকিদের আনতে চলে গেসে। পথিমধ্যে একটা কুকুর ছানার সঙ্গ পেলাম আমি, খেলতে লেগে গেলাম। ততক্ষনে বাস এসে গেসে, ভাবলাম বাচ্চাটাকে নিয়ে নেই, পরে কোথায় ছেড়ে দিবো। কী ভেবে আর তা করি নি।
অনেক রাস্তা পার করে, জ্যাম ঠেলে পৌছলাম হোটেলে। ফ্রেশ হয়ে দেখি যে যার মতো করে হোটেলে খাইতে গেসে। যাই হোক, জানি না কেন কিন্তু ট্যুরে গেলে আমার খালি তাহমিদ সাথে থাকলেই চলে। তাহমিদ, আমি, অন্তিক, মাইশা, কৌশিক, ইমন, উমামা এবং আরো ব্যক্তিবর্গ চললাম জামানের উল্টাদিকের সবুজ হোটেলে খাইতে। যাই জিজ্ঞেস করি আছে কী না, প্রথমে বলে আছে। পরে অর্ডার দিতে গেলে বলে এটা এতগুলা হবে না, এটা শেষ হয়ে গেসে। ওয়েল, খাওয়া দাওয়া ট্যুরে গেলে এমনিতেই কম হয়, কেন জানি। কোনোমতে খেয়ে বিল দিয়ে বেরিয়ে এলাম। তখন আবার বেয়ারাগুলা নির্লজ্জের মত বকশিশ চাইতেসে। হাতে ২০ টাকা ধরায় বললাম, “আর আসতেসি না এই হোটেলে, সার্ভিস ভালো করেন”রাতে এসে হালকা একটা মিটিং করে যে যার রুমে চলে গেল। আমরা কিছু মানুষ নাজিব আর অন্তিকের রুমে শ্যারেডস খেলে রাত ৩টা পর্যন্ত আড্ডা দিলাম। আড্ডা শেষে রুমে গিয়ে দেখি সাইফ আর রিদি তখনোও জাগনা। ঐ দুইটা টিভিতে দেখি বাংলা সিনেমা দেখতেসে। গোসল করে কোনো এক অজান্তে ঘুমাইলাম রাত ৫টায়।
দ্বিতীয় দিন
সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে হোটেলের কিছু হিসাব চুকিয়ে গেলাম নাস্তা করতে। বেশী কিছু পেটে ঢোকেনি, ক্ষুধা কেন জানি কম ছিল। বাসে করে চললাম সীতাকুন্ডের পথে। আজ চন্দ্রনাথ পাহাড় জয় করবো !
চন্দ্রনাথ পৌছে লাঠি কেনা হল একগাদা। একে একে সবাই হেটে, দৌড়ে উঠা শুরু করলাম লাঠির সাহায্য নিয়ে। মাঝপথে অনেক জায়গায় দাঁড়িয়ে, বিশ্রাম নিয়ে আবার চললাম, এক সময় চূড়ায় উঠে গেলাম। ছবি তুললাম বেশ কয়েকটা, গ্রুপ ফটো, সিঙ্গেল ফটো, জোড়ায় জোড়ায় ডাবের পানি খেলাম সেন্ট্রাল ফান্ড থেকে। তারপর নামার পালা, অন্য এক রাস্তা দিয়ে নামা শুরু করলাম সবাই। উঠা আর নামার রাস্তা আলাদা হওয়াতে ভালই হয়েছে। এক রাস্তা দিয়ে আরেক রাস্তার কাজ করা যেত না। তারমধ্যে ধ্রুব তীরে এসে তরী ডুবালো। রাস্তার শেষ পর্যায়ে এসে দিসে এক দৌড়, উষ্ঠা খেয়ে পড়ে ব্যাথা পাইসে। যদিও বেশি গুরুগম্ভীর কিছু হয় নাই, আল্লাহর রহমতে।
চন্দ্রনাথের পার্ট শেষ করে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম সেখানকার এক হোটেলে। কাচ্চি বিরিয়ানীর নামে যে কি ভুগিচুগি বিরিয়ানী দিবে, তা আমার জানাই ছিল। তাই দুপুরের খাবার কোনো একভাবে সেরে ইকো পার্কের দিকে ছুটলাম সবাই। ইকো পার্কে তেমন কিছু নাই, দুইটা ঝর্না ছাড়া। সুপ্ত ধারা ঝর্নায় মনে হইয় পানি কম ছিল, তাই সহস্র ধারা ঝর্না দেখতে গেলাম। ঝর্না তো খালি দেখা যায় না, দেখার পর ভিজতেও মন চায়। ঝর্নার অল্প কিছু পানিতেই সবাই মিলে ভিজলাম। ভেজা শেষে হাইক করে পার্কের রাস্তায় উঠে অটো রিসার্ভ করে আসলাম মেইন স্পটে। এখানে নাকি ছিনতাই এর ঘটনা ঘটে, তাই সর্বদা সতর্ক ছিলাম। অটোতে করে আসার পর অনেকে কাপড় চেঞ্জ করলো, আমার আর কী করার, কাপড় অল্প কিছুক্ষনেই শুকিয়ে গেল।
তারপর আমরা পতেংগা সী বীচের দিকে রওনা দিলাম। হাই-রোডে কোনো জ্যামই ছিল না, কিন্তু সিটিতে ঢোকার পর এত জ্যামের সম্মুখীন হইলাম যে দাড়ায়ে দাড়ায়ে ঘুমাইলাম ১ ঘন্টা। বীচে পৌছায় অন্ধকারেই দৌড়াদৌড়ি করলাম, কাকড়া, মুড়ি খাইলাম। গ্রুপ ফটো তোলা শেষে এবার হোটেল ফেরত আসার পালা। আসার রাস্তাতেও জ্যাম, প্রায় ৩ ঘন্টার জ্যাম কাটায়ে কোনো মতে রাত ১১ঃ৩০ এ পৌছায় রাতের খাবার খেয়ে রুমে চলে গেলাম। আজও সেইরকম আড্ডা হলো !
তৃতীয় দিন
আজকের সকালের রুটিনও সেইম, নাস্তা শেষে মহামায়া লেকের উদ্যেশ্যে রওনা দিলাম। বাসে মজা করতে করতে পৌছলাম মহামায়াতে। দুটা স্পীডবোট ভাড়া করে সেখানের ঝর্নার উদ্যেশ্যে রওনা হলাম। পথিমধ্যে জাবের নামের এক বেয়াদব ছেলের কারণে আমার চোখের চশমা লেকের পানিতে পড়ে যায়। কিছু উত্যপ্ত বাক্য বিনিময় করে আমি আর কিছু বলিনি। সানগ্লাস পড়েই পরবর্তী টাইম কাটালাম। কিন্তু আমার চশমা হারা যাওয়াটা বেশ রিস্কি ছিল, ঝর্না যাওয়ার পথে বেশ কেয়ারফুল থাকতে হয়েছে।
সেখানের ঝর্নাতে ইচ্ছামত, প্রাণখুলে ভিজলাম- অনেকেই ভিজতে চায়নি। তারা যে কী আনন্দ মিস করলো ! মহামায়ার মহাকাব্য শেষ করে আমরা চললাম ভালো একটা হোটেল খুজতে, দুপুরে আজ ভাল খাবো এই আশায়। মোটামুটি একটা ভালো রেস্টুরেন্টে আহার কার্য সেরে আমরা চললাম ট্যুরের শেষ জায়গাটি ঘুরতে- গুলিয়াখালী সী বীচ। সেখানে যাওয়ার জার্নিটাই সবচেয়ে এনজয়িং ছিল ! রাস্তায় দুটি ঘটনা ঘটলো-
আমাদের বাস থামালো এক পুলিশ অফিসারঃ কেও কিছু বুঝলো না, ড্রাইভারও দেখি ভদক্সের মত সীটে বসে আছে। আমি উঠে বাইরে গেলাম ঘটনা জানার জন্য। উনাকে কিছুটা সেটিং দেয়ার পর উনি রাস্তা ছাড়লেন। আমি আবার গিয়ে বসলাম বাসে, বাস চলা শুরু করলো।
তারপর আসলো দ্বিতীয় ঘটনা, এত বড় বাস নাকি ভিতরের ছোট রাস্তা দিয়ে যেতে পারবে না। তাই নাকি হাইওয়ে থেকে মিনিবাস ভাড়া করে যেতে হয়। তাই আমরা এক মিনিবাসে ঠেলাঠেলি করে উঠে চললাম গুলিয়াখালীর পথে। সেই বাস চলার সময় আমরা যেন পুরো মহাবিশ্ব নিয়ে আলাপ করলাম। বাসের ভেতরের মহিলা আসনে যারা বসছিল- তাদেরকে পাবলিক শেমিং করলাম। গরু বাছুরের সাইজ ভালোই বড়, তাই রিদি চাচ্ছিলো আমরা যেন আসার পথে একটা বাসে ঢোকায় নিয়ে আসি।
গুলিয়াখালী পৌছাবার পর হেঁটে কিছুদূর যেতে হয়, তারপর থেকে শুরু হয় সবুজ ঘাসের নরম কার্পেট। ইচ্ছা করেই খালি পায়ে হাটা দিলাম, ফিল নিতে। সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে আর রিদি, তাহমিদ, নকশীর চশমা ধার নিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। মন চাচ্ছিল যেন সন্ধ্যাটা সেখানেই পার করি, রাতের আঁধার সেখানেই বসে কাটাই এবং রাতশেষের সূর্যটা দেখে তারপর ঘরে ফিরি।
চিটাগং শহরের জ্যামকে ধন্যবাদ দিতে চাই আমাদের রাতের মেজবান খাওয়ার আয়োজনটা ভঙ্গ করে দেবার জন্য। মেজবান খাওয়া আর রাতের ট্রেন ধরার থ্রিলিং এক্সপেরিয়েন্সটা নাহলে পেতে হত না। সেই রাতেই ট্রেনে উঠে খাওয়া শেষে আমরা কিছু সিক্রেট সোসাইটির গল্প করি, যা আফটারম্যাথ নামে পরিচিত আমাদের কাছে। গল্পের পালা শেষ করে সেই ট্যুরের শ্যরেডস এর শেষ এপিসোড শেষ করে যেন ঘুমিয়ে যাই। সকালে আমাদের ট্রেন যখন তেজগাঁও পৌছলো, তখন আমার ঘুমটাও ভাঙল। চোখ খুলে আবিষ্কার করলাম যে, আমার চোখে যে চশমাটি ছিল- সেটি উধাও